বাবার হত্যার বিচারের উদ্দেশ্যে আইনজীবী হয়ে ২৫ বছর পর বিচার পেলেন

তাপস চন্দ্র সরকার।

কুমিল্লা বরুড়ায় জায়গা সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবীর পিতাকে হত্যার দায়ে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন কুমিল্লার আদালত। সোমবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরবেলা কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ৩য় আদালতের বিচারক রোজিনা খান এ রায়ে দেন। যাহার দায়রা মামলা নং- ২৩৮/২০০৬।

মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- কুমিল্লা বরুড়া উপজেলার পরানপুর গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে ইউছুব, বনি আমীন, ইউছুবের ভাতিজা সোলায়মান, আসামি ইউছুবের শ্যালক ও মৃত আঃ মতিন এর ছেলে আঃ হক এবং মহিলা বিবেচনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামি হলেন আসামি ইউসুফ এর বড় বোন রজ্জবী বিবি।
মামলার বিবরণে জানা যায়- জায়গা সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ১৯৯৮ সালের একুশে মে দিনের বেলায় আসামিদের সঙ্গে ওই আইনজীবির বাবা ফার্ণিচার ব্যবসায়ি মোঃ শহীদ উল্লাহ’র কথা-কাটাকাটি, তর্কবির্তক ও হাতাহাতি হয়। এ ঘটনার জের ধরে ঐদিন দিবাগত-রাত সাড়ে ৮টার দিকে আসামিরা আইনজীবির বাবাকে পরানপুর বাজারের পশ্চিম পাশে বিরোধীয় জমিতে ডেকে নিয়ে আসামিদের হাতে থাকা ধারালো অস্ত্রদ্বারা ভিকটিম শহীদ উল্লাহকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম করে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে বাদী ও অন্যান্যরা ভিকটিমকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে কুমিল্লায় হসপিটালে নেওয়ার পথে পথিমধ্যে লালমাই নামক স্থানে মৃত্যু বরণ করেন। এ ব্যাপারে নিহতের ছোটভাই ও বরুড়া বিজরা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মৃত আবদুল মজিদ এর ছেলে মোঃ আমান উল্লা বাদী হয়ে ১৯৯৮ সালের ২২ মে একই গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে মোঃ ইউসুফসহ ১৫ জনকে আসামি করে দঃ বিঃ ৩০২/৩৪ ধারার বিধানমতে বরুড়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করিলে তদন্তকারী কর্মকর্তা এস.আই সৈয়দুল মোস্তফা, বরুড়া থানার তৎকালীন অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) মোঃ ফজলুল হক ও পুলিশ পরিদর্শক (সিআইডি) মোঃ সিরাজুল হক ঘটনার তদন্তপূর্বক আসামি মোঃ ইউসুফসহ ১৫জনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ১৯৯৯ সালের ৮ই এপ্রিল একটি এবং ২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর আরেকটি সম্পূরক অভিযোগপত্র বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করেন (যাহার অভিযোগপত্র নং- যথাক্রমে ২৫ ও ২৫ (ক)। তৎপর মামলটি বিচারে আসিলে আসামিগণের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় চার্জ গঠন করে রাষ্ট্রপক্ষে ২০জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণক্রমে আসামিগণের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাহাদিগকে সংশ্লিষ্ট ধারায় দোষী সাবস্থক্রমে আসামি কুমিল্লা বরুড়া উপজেলার পরানপুর গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে ইউছুব, বনি আমীন, আসামি ইউনুছ এর ছেলে সোলায়মান, আসামি ইউছুফের শ্যালক ও মৃত আঃ মতিন এর ছেলে আঃ হককে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করেন। রায়ে আরও উল্লেখ করেন মৃতুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিগণের মৃত্যু দণ্ডাদেশ মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত রুজ্জুতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করেন এবং মহিলা বিবেচনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামি হলেন আসামি ইউসুফ এর বড় বোন রজ্জবী বিবিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। বাকী আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদেরকে খালাস প্রদান করেন।
রাষ্টপক্ষের কৌশলী আইনজীবী এপিপি মোঃ নুরুল ইসলাম এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আশা করছি মহামান্য হাইকোর্ট এ রায় বহাল রেখে দ্রুত রায় বাস্তবায়ন করিবেন এবং আসামিপক্ষের এডভোকেট আঃ মমিন ফেরদৌস বলেন, এ রায়ের কপি হাতে পেলে আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে আপীল করবে ইনশাল্লাহ। এছাড়াও রাষ্ট্রপক্ষে নিযুক্তীয় বিজ্ঞ কৌশলীর পাশাপাশি মামলার ব্যক্তিগত আইনজীবী ছিলেন- কুমিল্লা বারের সিনিয়র এডভোকেট মোঃ মাসুদ সালাউদ্দিন ও নিহতের ছেলে এডভোকেট মোঃ আবু নাসের।
এদিকে, বাবা হত্যাকারীদের বিচারের উদ্দ্যেশে আইনজীবী হয়ে লড়াই করে ২৫ বছর পর বিচার পেলেন। জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে খুন করা হয় ওই আইনজীবির বাবাকে। সেই ছেলে নিজেই আইনজীবী হয়ে বাবার খুনের সেই মামলায় লড়ে ২৫ বছর পর বিচার নিশ্চিত করেছেন। বাবাকে খুন করার সময় ওই আইনজীবী পঞ্চম শ্রেণিতে লেখাপড়া করতেন।
মামলায় ১৫জন আসামির মধ্যে রায় ঘোষণাকালে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত চারজন ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত একজন আসামি আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বাকীরা মামলার দায় হইতে অব্যাহতি পায়। এর মধ্যে ৩জন আসামি মামলা চলাকালীন সময়ে মৃত্যু বরণ করেন।
নিহতের ছেলে আইনজীবী মোঃ আবু নাসের রায় ঘোষণার পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন- আমার পিতাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আমি আমার মায়ের অনুপ্রেরণায় পিতার খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতে আইনজীবী হয়েছি। ২৫ বছর পর হলেও একজন সন্তান হিসেবে আমি আমার পিতা হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে পেরেছি, এটা আমার অনেক বড় পাওয়া।

আরো পড়ুনঃ