অর্থনৈতিক ডেস্ক নিউজ।।
দেশের অর্থনীতি একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে। ধারণা করা যায়, খুব শিগগিরই এ সংকট কাটবে না, বরং আগামী বছরগুলোয় তা তীব্রতর হবে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির নানা প্রতিকূলতার মধ্যে রিজার্ভ সংকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রিজার্ভ সংকটের কারণে দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রতিনিয়ত কমছে। একদিকে অর্থনীতির নানামুখী সমস্যা রিজার্ভ সংকট সৃষ্টি করেছে আবার রিজার্ভ সংকট অর্থনীতির অন্যান্য সমস্যাকে তীব্রতর করছে। ইতোমধ্যে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
দুই মাসের ব্যবধানে ১২ দফা বাড়ানো হয়েছে ডলারের দাম। আলোচ্য সময়ে টাকার মান কমেছে ৭.২৫ টাকা। এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৯৩.৪৫ টাকা। এটি মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত কাগুজে হার। তবে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করছে ৯৮-৯৯ টাকা দরে। এর আগে মে মাসে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়েছিল।
এখন ব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রেই এই দাম ১০০ টাকা ছুঁইছুঁই করছে। এই দফায় কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম কত পর্যন্ত উঠবে, তা কারোর পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। গত ২৯ মে দেশে ডলারের দর ৮৯ টাকা বেঁধে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ডলারের দর উঠিয়ে দিয়ে তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। আর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পর ছয়বার বেড়েছে ডলারের দাম।
আমদানি খরচ বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় দেশে মার্কিন ডলারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় রপ্তানি আয় কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও তা ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। এজন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আর এ কারণে রিজার্ভ সংকট তীব্রতর হচ্ছে। গত ২৭ জুন কয়েকটি ব্যাংকের কাছে বিক্রি করা হয় ৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করল ৭৪৩ কোটি ডলার। আসলে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ও পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা অনুমান করা সত্যিই কঠিন।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের বিনিময় হারের ব্যবধান বেশি হওয়ায় ইনফরমাল (অবৈধ) চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসার আশঙ্কা বাড়ছে। এতে সামনের দিনগুলোয় বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা আসার পরিমাণ কমে যাবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর।
গত বছরের তুলনায় রপ্তানি আয় বাড়লেও সাম্প্রতিক মাসগুলোয় এই আয় নিম্নমুখী। গত মে মাসে ৩৮৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের (জুলাই-জুন) গত আগস্টের পর এক মাসে সর্বনিম্ন রপ্তানি আয়। অর্থাৎ টানা ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রপ্তানি আয় এসেছে গত মে মাসে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের নীতি-নির্ধারণী সুদহার বাড়ানোর চক্রবৃদ্ধি প্রভাব দেখা যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে অন্যান্য উন্নত অর্থনীতিকেও তাদের সুদহার বাড়াতে হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোয় মানুষের হাতে অর্থের প্রবাহ কমে আসায় চাহিদার পরিমাণ কমে আসবে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের রপ্তানি আদেশও কমবে। আবার, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে সুদ হার বাড়াচ্ছে, তাতে বায়াররা চেষ্টা করবে আমাদের তৈরি পোশাকের দাম কমিয়ে বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে আমাদের রপ্তানি আয় কমে যাবে।
টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে ইকুইটি, পোর্টফোলিও, এমনকি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে। টাকার মানের অবমূল্যায়নের কারণে ইতোমধ্যে শেয়ারবাজার থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ উঠিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা?
গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০, ৫ বছরে পাচারকারীরা ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। যার মধ্যে শুধু ২০১৫ সালে ১ বছরেই দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এটি আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে করা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচারকৃত অর্থের হিসাব।
বলা বাহুল্য, এর বাইরে হুন্ডিসহ অন্যান্য ইনফরমাল চ্যানেলে আরও অনেক অর্থ পাচার হয়েছে, হচ্ছে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে এই পাচার আরও বেড়েছে। গত এক বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের নামে জমা টাকার পরিমাণ ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বছরের পর বছর ধরে নিয়মিতভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হলেও তা রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
উপরন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরের অনুমোদিত অর্থবিলে ফেরত আনার নামে পাচারকৃত অর্থের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। পাচার হওয়া টাকা দেশে আনলে সেই টাকার ওপর ৭ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারবেন যে কেউ। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেবে না সরকার। তাকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। আয়ের উৎসসহ নিয়মিত কর পরিশোধ করলে যেখানে প্রতিবছর ১৫-২৫ শতাংশ কর পরিশোধ করতে হতো, সেখানে মাত্র ৭ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থের বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রবাসী আয় বাবদ দেশে যত পরিমাণ ডলার পাঠানো হোক না কেন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো।
আগে পাঁচ হাজার ডলারের বেশি আয় পাঠাতে আয়ের নথিপত্র জমা দিতে হতো। এখন বিদেশেও কেউ প্রশ্ন করবে না, আর দেশে তো করবেই না। এর ফলে পাচারকৃত অর্থ বৈধ চ্যানেলে ফেরত নিয়ে আসতে পারবেন পাচারকারীরা। আবার এর বিপরীতে আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনাও দেওয়া হবে। এককথায় বলা যায়, এই প্রস্তাব পাচারকারীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তথা পৃষ্ঠপোষকতা। এর ফলে পাচারকারীরা আরও নিশ্চিন্তে বিদেশে টাকা পাচার করবেন। এতে সংকট আরও তীব্রতর হবে।
বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে প্রথম ৩৯ বছরে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা পরের ১০ বছরেই বেড়ে আড়াই গুণে দাঁড়িয়েছে। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে নেওয়া বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হবে।
সরকারকে এই ঋণের কিস্তি ডলারে পরিশোধ করতে হবে। ফলে রিজার্ভ সংকট আরও বাড়বে।
ডলারের সর্বসাম্প্রতিক এ মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ, অর্থ পাচার, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার কারণে রিজার্ভ সংকট তীব্রতর হবে, এটা বলাই বাহুল্য।
সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, যেখানে খাদ্যপণ্যে এর হার ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে এ হার আরও অনেক বেশি। দেশের অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বর্তমানে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১৫ শতাংশ এবং সার্বিকভাবে এ হার প্রায় ১২ শতাংশ। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করলেও বাজেট প্রস্তাবের পর রেকর্ড হারে বেড়েছে খাদ্য-পণ্যের দাম।
এ মূল্যস্ফীতির পেছনে মূলত টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি দায়ী। রিজার্ভ সংকট আরও তীব্র হলে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম এবং মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সুতরাং সংগত কারণেই দেশের অর্থনীতি নিয়ে গভীর ভাবনার অবকাশ রয়েছে।সূত্র যুগান্তর