আলজাজিরার ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন
পথিকৃত ডেস্ক।।
গত দুই দিনে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল ‘আলজাজিরা’য় বাংলাদেশের ওপর করা অনুষ্ঠানগুলো দেখে মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- এখানে কত টাকার আলজাজিরার ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন
গত দুই দিনে কাতারভিত্তক টেলিভিশন চ্যানেল ‘আলজাজিরা’য় বাংলাদেশের ওপর করা অনুষ্ঠানগুলো দেখে মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- এখানে কত টাকার খেলা চলছে? বিজ্ঞজনদের সুচিন্তিত ধারণা, এ অনুষ্ঠানগুলো করার জন্য এবং অনুষ্ঠান প্রস্তুতির জন্য যে সময় তারা ব্যয় করেছে, তাতে টাকার অঙ্ক কয়েক মিলিয়ন ডলারের নিচে হতে পারে না। বাজারে যে কথাটি চাউর হয়ে গেছে, সেটি হলো- বিএনপি-জামায়াত এ টাকাগুলোর ব্যবস্থা করেছে এবং তাদের উদ্দেশ্য হলো, বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক সরকারকে অসাংবিধানিকভাবে, বেআইনিভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা। এ ব্যাপারে তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু পেতে ষড়যন্ত্রকারীদের কোনোই অসুবিধা হয়নি।
কেননা ড. কামাল হোসেনের মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেনের স্বামী ডেভিড বার্গম্যান তো সদাই হাজির হুজুর।
নির্ভরযোগ্য খবর বলছে, এই ডেভিড বার্গম্যানই আলজাজিরার অনুষ্ঠানগুলোর নীলনকশা তৈরি করেছেন এবং অনুষ্ঠানগুলো যে কজনের চিন্তার ফসল, ডেভিড বার্গম্যান তাদেরই একজন। এ কুচক্রীরা যে দীর্ঘ সময় ধরে এ অনুষ্ঠানগুলো তৈরির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ অনুষ্ঠানগুলোর পেছনে যে ষড়যন্ত্র নিহিত রয়েছে তা উদঘাটনের জন্যই প্রয়োজন ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন। যাতে সবাই বুঝতে পারেন এরা কারা? কী-ই বা তাদের অতীত, কী-ই বা তাদের উদ্দেশ্য।
ডেভিড বার্গম্যান ছিলেন যুক্তরাজ্যের অতি নগণ্য পর্যায়ের একজন সাংবাদিক। তিনি কয়েক বছর আগে হঠাৎ বিলেতে এক টেলিভিশন চ্যানেলে আমাদের দেশের ’৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের ওপর প্রামাণ্যচিত্র করার সময় সেখানকার বাঙালি মহলের কাছে পরিচিত হন।
এরপর ড. কামাল হোসেনতনয়া ব্যারিস্টার সারা হোসেনের স্বামী হিসেবে তিনি বাংলাদেশে আসার পরপরই জামায়াতি যুদ্ধাপরাধীদের টাকা গিলে ফেলে তাদের সুরেই গান গাইতে শুরু করেন। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাংবাদিকতা করতে শুরু করেন। শুধু তিনি একাই নন, তিনি তার শ্বশুর ড. কামাল এবং তার স্ত্রী সারা হোসেনকে এমনভাবে প্রভাবিত করেন যে, যেই ড. কামাল ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সাজা দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধুর একজন মন্ত্রী ছিলেন, সেই ড. কামাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের সময় মুখে কুলুপ দিয়ে পরোক্ষভাবে তাদের পক্ষই অবলম্বন করেন।
ডেভিড বার্গম্যান জামায়াতিদের দ্বারা এতই প্রভাবিত হন যে, আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার আপিল শুনানিকালে তিনি আদালতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকাকালে আমি সেই মামলার একজন বিচারপতি হিসেবে তাকে আদালত থেকে বের করে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। ডেভিড বার্গম্যানের ষড়যন্ত্র চলতে থাকে জামায়াতিদের সঙ্গে। পরবর্তীতে এক পর্যায়ে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হলে তিনি লন্ডন ফিরে গিয়ে জামায়াতি নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক, যিনি দেশে থাকাকালে যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন, তার সঙ্গে মিলিত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোট সরকারকে অবৈধভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অশুভ তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকেন। লন্ডনে বসবাসরত এমন কিছু রাষ্ট্রদ্রোহী প্রাক্তন সামরিক, বেসামরিক ব্যক্তির সঙ্গে, যারা তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, এই ষড়যন্ত্রকারীদের সখ্য গড়ে ওঠে। বিলেতে তারা আর্থিক দিক থেকে বেশ ভালো অবস্থায়ই আছেন, কাটাচ্ছেন বিলাসী জীবন।
আলজাজিরার অনুষ্ঠানগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে, ‘জেমস বন্ড ০০৭’-এর অনুষ্ঠান দেখছি। যার সবকিছুই কাল্পনিক।
তাদের কোনো দাবির পক্ষেই কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। সবই মনগড়া। অনুষ্ঠানগুলো বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে শূন্যের কোঠায়। তারা আমাদের সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ সম্পর্কে যেসব হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বলার চেষ্টা করেছেন, সেগুলো একান্তই বালসুলভ। দেশের সেনাপ্রধানের ছেলের বিয়েতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যাবেন, এটা যদি কেউ অস্বাভাবিক মনে করেন তাহলে তার চিন্তা-চেতনা কতখানি সুস্থ সেটি বিরাট প্রশ্ন বইকি। আর মহামান্য রাষ্ট্রপতি বা কোনো ভিভিআইপি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে সেখানে তাকে ঘিরে অনেকেই ছবি তুলে থাকেন। কে বা কারা তার সঙ্গে ছবি তুলেছেন, সেটা যাচাই করা নিশ্চয়ই ভিভিআইপি ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়।
জেনারেল আজিজের ভাই-ই যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করেছেন তা নতুন কিছু নয়। বহু বছর আগে জিয়াউর রহমান সাত খুনের জন্য সাজাপ্রাপ্ত শফিউল আলম প্রধানকে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর প্রথম ক্ষমা করেছিলেন। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রপতি বহুজনকে ক্ষমা করেছেন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খুনের জন্য দন্ডপ্রাপ্ত সুইডেনে পলাতক এক লোককে খালেদা জিয়া এবং তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ সাহেবের পরামর্শক্রমে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন সাহেব ক্ষমা করেছিলেন। সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে এই বিশেষ ক্ষমতাটি দিয়েছে। এ জন্য যে, তিনি সবকিছু বিবেচনার পর যদি মনে করেন বিচারে কোনো ত্রুটি থেকে থাকতে পারে, তাহলে ন্যায়ের স্বার্থেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করতে পারেন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এ বিধান রয়েছে। জেনারেল আজিজের ভাই হারিস তার ভাইয়ের নাম ভাঙিয়ে, তার অবস্থানের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন বলে যে কথা আলজাজিরায় বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত। এ দাবির পক্ষে তারা ন্যূনতম প্রমাণ দিতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী জেনারেল আজিজকে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছেন, তাদের এই অর্বাচীন উক্তির পক্ষে তারা কোনো প্রমাণই দেখাতে পারেনি। তারা এক ব্যক্তিকে হাঙ্গেরির এক কর্মকর্তা বলে উপস্থাপন করেছে। অথচ ওই ব্যক্তি যে সত্যি সত্যিই হাঙ্গেরিয়ান কর্মকর্তা তার পক্ষে সমর্থনসূচক কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি। তুরস্কসহ বেশ কিছু দেশ আজ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার এবং উন্নয়নের চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়। কোনো অবস্থায়ই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নয়। অথচ আলজাজিরা এই মর্মে ভুয়া কথা বলল যে, বাংলাদেশ নাকি ইসরায়েল থেকে গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি কিনছে। এ কথা যে সর্বৈব অসত্য তা আলজাজিরার অনুষ্ঠানই প্রমাণ করে। কেননা তাদের তথ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি কিনেছে হাঙ্গেরি থেকে।
আলজাজিরার মিথ্যাচার নতুন নয়। মিথ্যা সংবাদ প্রচারের কারণে সৌদি আরব, মিসর, বাহরাইন, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ আলজাজিরার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেছে। এ টেলিভিশনটি যে জঙ্গি মৌলবাদী সংস্থা ইসলামিক ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাও কারও অজানা নয়। সুতরাং মৌলবাদ প্রচার করে বাংলাদেশসহ গণতান্ত্রিক দেশসমূহে অসাংবিধানিকভাবে সরকারের পতন ঘটানোর জন্য তারা সদাপ্রস্তুত এবং এ উদ্দেশ্যেই তাদের এই দুই দিনের অপপ্রয়াস। তাদের এ কর্মকান্ডের সঙ্গে নিশ্চিতভাবে জেনারেল সোহরাওয়ার্দীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য, বিদেশে পদচ্যুত রাষ্ট্রদ্রোহী কিছু সাবেক সেনা কর্মকর্তা যথা মেজর দেলোয়ার, কর্নেল শহিদুদ্দিন খান, যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়া সাংবাদিক কনক সরওয়ার, ইস্তাম্বুলে থাকা মাহমুদুর রহমান, সুইডেনে বসবাসরত তাসিমিন খলিল গং কয়েক বছর ধরে যেসব মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে আলজাজিরার অনুষ্ঠান তারই ধারাবাহিকতায় প্রচারিত হচ্ছে। যে ৪২ জন মুখচেনা ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে উদ্ভট এবং আইন-অসমর্থিত কথা বলছেন, সেটিও এ ষড়যন্ত্রেরই অংশ। তাদের মনে রাখা উচিত, বর্তমানে নির্বাচিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের ও দেশের উন্নয়নের জন্য সারা বিশ্বের রোল মডেল হওয়ার কারণে, অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা বিরাজমান, তাতে এই কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে-বিদেশে যে ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন তার প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম এবং গণতন্ত্রের প্রতি একনিষ্ঠতার কারণে তা আলজাজিরার ষড়যন্ত্রকারীরা ক্ষুণœ করতে পারবে না।
১৯৭১-এর পরাজিত অপশক্তিরাই যে এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তারা এখনো চেষ্টা করছে আমাদের গৌরবের সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যরা এই ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তির কথায় বিভ্রান্ত হওয়ার নয়।
দুই দিন ধরে সব মানুষের মনেই একটি প্রশ্ন- এত টাকা এই ষড়যন্ত্রকারীরা কোথা থেকে পাচ্ছে? সবার দাবি, তাদের অর্থের উৎস খুঁজে বের করা অপরিহার্য।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।