ফুলে ফুলে সকলকে হাতছানি দেয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক

 

বিশেষ প্রতিনিধি।

চট্টগ্রাম যেতে হলে ঢাকার দমবন্ধ হয়ে আসা দীর্ঘ যানজট কাটিয়ে চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওঠার পর প্রশস্ত আর মসৃণ সড়ক ধরে আগাতেই দেখা মিলবে এক অনন্য দৃশ্য।

দুই পাশের রাস্তার মাঝে সড়ক বিভাজকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা দেশীয় সব ফুলগাছ যে কাউকে বিমোহিত করবে। এই মহাসড়ক এখন রাধাচূড়া, টগর এবং সোনালুর মতো অপেক্ষাকৃত ছোট এবং কদম, জারুলগাছের মতো মাঝারি আকৃতির গাছ আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সাবেক সচিব এমএএন সিদ্দিক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে পাঁচ মিটার প্রশস্ত সড়ক বিভাজক সহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনের হাইওয়েতে উন্নীত করা হয়। ভবিষ্যতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কথা মাথায় রেখে বিভাজকের পরিকল্পনা করা হয়। উন্নত দেশে ফুলগাছ লাগিয়ে সড়ক বিভাজকের সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। বহু পর্যালোচনার পর গাছগুলো বাছাই করা হয়। গাছগুলোর প্রকৃতি বিচার করে তাদের নির্বাচন করা হয়েছিল। বেড়ে উঠতে কত দিন সময় প্রয়োজন, কী ধরনের যত্ন নিতে হবে, ফুলের মৌসুম কবে, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় শাখা-প্রশাখা কত দীর্ঘ হবে, গাছের ছায়া কতদূর বিস্তৃত হবে এবং তাদের উচ্চতা কতদূর পর্যন্ত হবে ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্ন সামনে রেখে দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সিদ্দিক এবং অন্য কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ লাভের মাধ্যমে বিভাজকে ফুলগাছ রোপণের প্রস্তাবনা তুলে ধরার সুযোগ পেলেন। তিনি সংক্ষেপে পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ব্যাখ্যা করেন।

সিদ্দিক বলেন, ‘ফুল ফোটার পর গাছগুলো দেখতে কেমন হবে, তা দেখানোর পাশাপাশি আমরা তাকে গাছের বেড়ে ওঠার বিভিন্ন ধাপ প্রদর্শন করলাম। নির্বাচিত ২৫টি ফুলগাছের ছবি আমি তাকে দেখালাম। প্রধানমন্ত্রীই আমাদের পরবর্তী ধারণাটি দিলেন। তিনি আমাদের এমনভাবে গাছ রোপণ করতে যেন সারা বছরই কোনো না কোনো ফুল ফুটে।’ সিদ্দিক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি গাছের নাম যুক্ত করার পাশাপাশি কিছু গাছ বাদ দেন। পরে ১৪টি গাছের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন পেতে একনেকের কাছে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। ফুলের গাছ লাগানোর সময় জোনভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।

সেই অনুযায়ী, নির্ধারিত জোন কেন্দ্র করে গাছগুলো লাগানো হয় যেন যাত্রীরা ভ্রমণের সময় সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত না হয়। প্রতি চার থেকে পাঁচ কিলোমিটারে আমরা প্রতি এক ধরনের বৃক্ষরোপণের সিদ্ধান্ত নিই, যাতে করে যাত্রীরা পুরো ভ্রমণকালেই তা উপভোগ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কুর্চি ফুলযুক্ত করার পরামর্শ দেন। তখন তা আমাদের কাছে ছিল না। কিন্তু যে কয়েকটি সম্ভব হয়েছে, আমরা সে কয়েকটি গাছ সংগ্রহ করি। পাঁচজন ঠিকাদার মহাসড়কের পাঁচটি অংশে গাছ লাগান।’

গাছগুলো রোপণের শর্তসমূহ সহজ ছিল না। শর্তানুযায়ী, ঠিকাদারদের এক বছরের মধ্যে সবগুলো গাছ রোপণ করার পাশাপাশি দুই বছর ধরে সেগুলোর যত্ন নিতে হবে। পাশাপাশি এই সময়কালের ভেতর কোনো গাছ মারা গেলে, গাছ ঠিকভাবে বেড়ে না উঠলে বা ঝড়ে কোনো গাছ পড়ে গেলে তার পরিবর্তে নতুন গাছ রোপণ করতে হবে।

৫২ হাজার গাছের মধ্যে আছে হৈমন্তী বা কুর্চি, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, টগর, কাঞ্চন, সোনালু, কদম, পলাশ, জারুল এবং করবী। সব থেকে বেশি রোপণ করা হয়েছে ৬ হাজার ৯৬০টি সোনালুগাছ। অন্যদিকে, সব থেকে কম আছে বকুলগাছ। মহাসড়কে বকুলগাছের সংখ্যা ২ হাজার ২৯০টি।

দুই বছর ধরে ঠিকাদাররা গাছের দেখাশোনা করার পর বর্তমানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো গাছের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে। স্থানীয়দের মনোভাবেও পরিবর্তন লক্ষ করার কথা জানান সিদ্দিক।

স্থানীয় বাসিন্দারা এসব ফুল তুলেন না। হাইওয়ে দিয়ে যাতায়াতকারীরাও এই উদ্যোগের প্রশংসা করেন। মানুষ এখন বিলুপ্তের পথে থাকা বহু বৃক্ষরোপণ করছে।

সিদ্দিক বলেন, ‘হাইওয়ে দিয়ে যখন যাতায়াত করি তখন আমার ভীষণ আনন্দ লাগে। আমাদের অনেক কর্মকর্তাই প্রকল্পটির জন্য আমাকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। তারা বলেন, বিষয়টি আমার মস্তিষ্কপ্রসূত এবং এর সফলতাও আমার জন্যই সম্ভব হয়েছে। সত্যিই আমার খুব ভালো লাগে।’

প্রকৃতিপ্রেমীরা যা বলছেন : প্রকৃতিপ্রেমী মোকারাম হোসাইনের মতে, মহাসড়কে ফুলের গাছ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ সন্দেহাতীতভাবেই ইতিবাচক। কিন্তু তাদের আরো পরিকল্পিতভাবে গাছগুলো রোপণ করা উচিত ছিল। গাছগুলো নির্বাচনের আগে তারা উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিলে ভালো হতো। কাঞ্চনের মতো কিছু গাছ আছে, যা সড়কে ছড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া তারা কাঠগোলাপের মতো গাছ রোপণ করতে পারত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ধীরগতিতে বেড়ে ওঠা কাঠগোলাপ সারা বছর ফুল দেয়।

তবে সিদ্দিক জানান, তারা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আরবরিকালচার বিভাগের পরামর্শ অনুসারেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

আরো পড়ুনঃ