করোনায় স্তব্ধ জনজীবন। আতংক নিয়ে দিন কাটছে সবার। এরই মাঝে বিদায় নিলো ২০২০ সাল। গত এই একটি বছর ছিলো বেদনা বিধুর। কতজন স্বজন হারা হলো। কারো আয়ের একমাত্র উৎস চাকরিটাও নেই। ঘরে পর্যাপ্ত খাবার ছিলো না অনেকের। নানানভাবে ক্ষত-বিক্ষত সবার মন। তাই গত বছরটা ছিলো আতংকের-স্বজন হারানোর। এসব কিছুকে পেছনে ফেলে আমাদের মাঝে নতুন স্বপ্ন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এলো ২০২১ সাল। নতুন বছরকে বরণ করতে কতজনের কত পরিকল্পনা ছিলো। কেউ বাজি ফুটিয়েছেন, কেউ বিভিন্ন অনু মাধ্যমে নতুন বছরকে উদযাপন করেছেন। কিন্তু ব্যতিক্রমভাবে নতুন বছরটিকে স্বাগত জানালো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জাগ্রত মানবিকতা। বছরের প্রথম দিন শতাধিক ব্যাগ রক্ত দান করলো জাগ্রত মানবিকতা পরিবারের সদস্যরা। পাশাপাশি হসপিটালে চিকিৎসাধীন বিভিন্ন রোগীর স্বজনদের হাতে রক্তের ব্যাগগুলো তুলে দিলো। সেই রক্তে প্রান বাঁচলো রোগীদের। হাসিফুটে উঠলো রোগীর স্বজনদের মাঝে। ওই সময় জাগ্রত স্বেচ্ছাসেবকদের কল্যান কামনায় রোগীর স্বজনরা দু’হাত তুলে দোয়া করেন।
জাগ্রত মানবিকতার স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, নতুন বছরের প্রথম দিন ছিলো শুক্রবার। পবিত্র একটা দিন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবীরা সকাল ৯ টা থেকে রক্ত দানের কাজ শুরু করেন। নগরীর বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারি হাসপাতালে চলে রক্ত দানের কাজ। হাসিমুখে প্রতিটা সদস্য রক্ত দান করেন। ১শ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করার কথা থাকলেও নতুন ডোনারদের আগ্রহে টার্গেট পূরণ হয়ে আরো বেশী পরিমান রক্ত দান করা হয়। রাত ১১টা পর্যন্ত চলে রক্ত দান। পরে জরুরী অপারেশনের রোগীর স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয় সেই রক্ত। এমন কাজে স্বেচ্ছাসেবকদের চোখে মুখে কোন ক্লান্তি ছিলো না। মানুষের জন্য কাজ করাটা স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে ইবাদতের মতোই ছিলো। তাই দিনভর রক্তদান ও বিতরনের কাজটি নিরবেই করে গেলো জাগ্রত মানবিকতার ভলিন্টিয়াররা।
জাগ্রত মানবিকতার সদস্যরা জানান, নতুন বছরের প্রথম দিন শতাধিক ব্যাগ রক্ত দান করেন। যার মধ্যে ওই দিনই অন্তত ৪৫ ব্যাগ রক্ত বিভিন্ন রোগীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বাকি রক্তগুলো বিভিন্ন হসপিটালের ব্লাড ব্যাংকে সংরক্ষণ রয়েছে। যাদের রক্তের প্রয়োজন হবে তারা জাগ্রত মানবিকতার সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করলে রক্তের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে বলে জানানো হয়।
এই রক্তদানের কাজে জাগ্রত মানবিকতার ৫৬ জন কো-অর্ডিনেটর কাজ করেন। কো-অর্ঢিনেটরদের একজন জাগ্রত মানবিকতার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কায়সার জামান কায়েস। তিনি অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, আমরা অসাধারণ একটি দিন পার করেছি। বছরের প্রথম দিন সংগঠনের সদস্যরা শতাধিক ব্যাগ রক্ত দান করেছে। কায়সার জামান কায়েস আরো বলেন, জাগ্রত মানবিকতার সাধারণ সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনা আপু সংগঠনের সদস্যদের উদ্দেশ্য সব সময় বলেন,শুভ চেতনার ধমনী কখনো রক্ত শূন্য হয় না। সেই স্লোগানকে ধারন করে মানবিক সমাজ বিনির্মাণে এগিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।
জাগ্রত মানবিকতার কো-অর্ডিনেটররা জানান, বছরের প্রথম দিন রক্ত দান করা অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি ফোন কল আসে। জরুরী ও পজেটিভ চার ব্যাগ রক্ত লাগবে। দূর্বৃত্তরা রিয়াজুর রহমান নামে এক কিশোরের পেটে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। তার বাবা কৃষক মাহালম মিয়া। রক্ত জোগাড় করা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন রোগী জানান, জাগ্রত মানবিকতার সাথে যোগাযোগ করলে রক্তের ব্যবস্থা হবে। বাবা কৃষক মাহালম মিয়া জাগ্রত মানবিকতার শরাণাপন্ন হন। খবরটি পেয়ে সাথে সাথে চার ব্যাগ ও পজেটিভ রক্ত নিয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে হাজির হয়। রক্তের ব্যাগগুলো ওই কিশোরের বাবা মাহালমের হাতে দেয়া হয়। হাতে রক্তের ব্যাগ পেয়ে কেঁদে ফেলেন কৃষক মাহালম।
এমন কিছু বিশেষ মুহূর্তের সম্মূখীন হয়। ওই সময়টার অনুভূতি বলে বুঝানো যাবে না।
বছরের প্রথম দিন শতাধিক ব্যাগ রক্তদানের বিষয়টি নিয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন কুমিল্লার বিশিষ্টজনরা।
ব্যতিক্রম অথচ মানবিক এমন কাজটি নিয়ে সাধুবাদ জানিয়েছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরী। তিনি বলেন, সংগঠনটি তাদের কাজের মধ্য দিয়ে অনুকরণীয় হয়ে আছে। এই সংগঠনটি একটি আদর্শ। একটি মডেল। অন্যান্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো জাগ্রত মানবিকতার মত হউক এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জণ নিয়াতুজ্জামান বলেন, করোনাকালে রক্ত পাওয়া খুবই দুরুহ কাজ। তবে আমি প্রত্যক্ষ করেছি জাগ্রত মানবিকতার সদস্যরা জরুরী মুহূর্তে রক্ত সংগ্রহের কাজটি খুব নিবেদিত প্রান হয়ে করতে। বছরের প্রথম দিন শতাধিক ব্যাগ রক্ত দান করা চাট্টিখানি কথা নয়। জাগ্রত মানবিকতা সংগঠনটির সাথে জড়িত সবার জন্য জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে রইলো শুভ কামনা।
নতুন বছরে প্রথম দিনে শতাধিক ব্যাগ রক্ত দান করার বিষয়ে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, মানবিকতা তৈরি হয়েছে অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানোর জন্য, তাদের সেবার জন্য।
আমি তাহসিন বাহার সূচনা ও আমার সংগঠন জাগ্রত মানবিকতা কুমিল্লাবাসীকে সেবা দিতে এসেছি। চার বছর ধরে আমরা সেই কাজটাই করে যাচ্ছি। আর এমন মহৎ কাজে সব সময় সহযোগিতা করে আসছে জাগ্রত ভলিন্টিয়াররা। তারাই সংগঠনের প্রাণ। ভলিন্টিয়াররা আমার কাছে সন্তানের মত। সংগঠনটি তৈরী হওয়ার চার বছরে এসে প্রতিদিন গড়ে ৩/৪ ব্যাগ রক্ত দান করে আসছে ভলিন্টিয়ররা। এছাড়াও কিছু রেয়ার গ্রুপের রক্তের জন্য আমাকে জানানো হয়। এমন মুহূর্তে হউক দিন কিংয়বা গভীর রাত, আমি যখনই যাকে জরুরী প্রয়োজনে রক্ত দেয়ার জন্য বলেছি হয় তারা নিজেরাই রক্ত দিয়েছে, নয়তো ডোনারের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ রোগীর স্বজনদের হাতে পৌছে দিয়েছে।
আসলে আমি চাই কুমিল্লার মানুষকে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ করতে। আমি সে লক্ষ্যেই হাটছি। যেখানে দলমত নির্বিশেষে সকল অসহায় নিপিড়িত মানুষের পাশে থাকবে জাগ্রত মানবিকতা।
আর্তমানবতার সেবায় অনুপ্রেরণা হিসেবে নিজের বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করে তাহসিন বাহার সূচনা। তিনি বলেন, কুমিল্লার গণমানুষের নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা আকম বাহাউদ্দিন বাহার আমার বাবা, আমার প্রেরণার বাতিঘর। উনার কাছ থেকেই শিখেছি কিভাবে মানুষের সেবা করতে হয়। আমার বাবাই আমার কাছে আদর্শ। আমার পথচলা আমার এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।–সূত্র: কুমিল্লার কাগজ