চৌদ্দগ্রামে ডাকাতিয়া-কাঁকড়ী নদীতে ভেসালে ক্ষতিগ্রস্থ মাছের প্রজনন
মো: মনোয়ার হোসেন।।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলাকে বিভক্তকারী ডাকাতিয়া নদীই দুই উপজেলার লক্ষাধিক নদী তীরবর্তী মানুষের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। মূলত বর্ষা মৌসুমে এ নদীর মাছই দুই উপজেলার বিভিন্ন চর, ছোট নদী, পুকুর, জলাশয়সহ সকল জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে বংশবিস্তার করে। কিন্তু বিপুল এ সম্ভাবনাময় নদীর মাছের বংশবিস্তার অতিরিক্ত ভেসালের ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমানে কিছু প্রভাবশালীর রাহুগ্রাসে ধ্বংশের ধারপ্রান্তে।
সরেজমিনে ডাকাতিয়া নদীর চিলপাড়া অংশে গিয়ে দেখা যায়, নদীর ১ কি.মি. অংশে প্রায় ৪-৫টি ভেসাল বসানো। নদীর দুই পাশে কারেন্ট জাল ও অন্যান্য জাল এবং মাঝখানে বসানো ভেসাল। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে নদীর এক অংশ থেকে আরেক অংশে একটি ছোটমাছও পার হতে পারে না। একইভাবে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মুন্সীরহাট ইউনিয়নের ছাতিয়ানী, বৈলপুর, কনকাপৈতের মরকটা, তারাশাইল, জাগজুর, গুনবতীর পরিকোটসহ বিভিন্ন অংশে এভাবে প্রায় শতাধিক ভেসাল বসানো। এছাড়াও বেশ কিছু অংশে নদীর সম্পূর্ণ অংশে কাঠের জালি, বাঁশের জালি দিয়ে বাঁধের মতো তৈরি করা হয়েছে। এতে মাছের বংশবিস্তার বাঁধাগ্রস্থ হওয়ার পাশাপাশি পানির স্বাভাবিক স্রোত বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে চলমান আমন মৌসুম এবং আসন্ত রবি মৌসুমে নদী সংলগ্ন অনেক নীচু জমিনে চাষাবাদের সাহস পাচ্ছেনা কৃষকরা। পাশাপাশি এসব জালে ডিমওয়ালা মাছ, পোনা মাছ আটকা পড়ায় মাছের বংশবিস্তারও বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, সমগ্র উপজেলায় প্রায় ২৭ কি.মি. জুড়ে ডাকাতিয়া নদী। এ নদীতে শৈল, কৈ, মাগুর, পুঁটি, বাইলসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছের সংখ্যাই বেশী। এ নদীতে উৎপন্ন মাছ অত্র এলাকার ৫০% মানুষের চাহিদা পুরণ করে থাকে। চৌদ্দগ্রাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলার একমাত্র বড় নদী ডাকাতিয়ায় প্রাকৃতিকভাবে মাছ উৎপাদন লক্ষমাত্রার শতকরা ৩০-৩৫% ক্ষতিগ্রস্থ হয় শুধুমাত্র ভেসালের ব্যবহারের মাধ্যমে।
এছাড়াও চৌদ্দগ্রামের উত্তর অংশের আরেকটি নদী কাঁকড়ি। নদীটি উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের মিয়াবাজারের পূর্বে ভারত অংশ থেকে শুরু হয়ে মিয়াবাজার এবং কাশিনগর ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডাকাতিয়া নদীর সাথে মিশে গেছে। এ নদীর প্রতি কিলোমিটারের মধ্যেই একাধিক ভেসাল লক্ষ্য করা গেছে। উপজেলার আরেকটি ছোট নদী কানাইল নদী। ভেসালের ব্যবহার থেকে রক্ষা পায়নি এ ছোট নদীটিও।
মৎস্য সংরক্ষণ আইনে ভেসাল, চুঙ্গিজালসহ স্থায়ী মাছ ধরার স্থাপনা বসানো নিষিদ্ধ। কিন্তু সরকারি এ বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে প্রতি বছরই ডাকাতিয়ার বুকে এভাবে প্রভাবশালীরা ভেসাল, কারেন্ট জাল ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের প্রজনন ক্ষমতাকে বাঁধাগ্রস্থ করছে। ভুক্তভোগী এবং সচেতন মহলের দাবী প্রশাসন অতি দ্রুত এসব ভেসাল এবং চুঙ্গিজালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে মাছের প্রজনন বাড়বে। এতে উপজেলার মানুষের মাছের চাহিদা পূরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে ডাকাতিয়া নদী। ভেসাল এবং চুঙ্গিজালসহ অন্যান্য জাল ব্যবহারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
কৃত্রিম-প্রাকৃতিক জলাশয়, জলমহাল এবং নদ-নদীতে মৎস্য সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখা এনাম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী এনামুল হক আশংকা প্রকাশ করে বলেন, ‘চৌদ্দগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে চলা নদ-নদী ও খালে উৎপন্ন মাছ উপজেলাসহ আশেপাশের এলাকার অন্তত ৫০% মাছের চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু এসব নদীতে ভেসালসহ বিভিন্ন জালের অবাধ ব্যবহারের ফলে মাছের প্রজনন ক্ষমতা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এসব জালে ছোট ছোট পোনা মাছ চালানসহ ধরা পড়ে। ফলে বিগত কয়েক বছর এসব নদীতে আশংকজনকহারে মাছ কমে যাচ্ছে। এসব জাল ব্যবহারীকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে নদীগুলোতে আর মাছই পাওয়া যাবেনা’।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মুরাদ হোসেন প্রামাণিক জানান, ‘ডাকাতিয়া নদীর চৌদ্দগ্রাম অংশ প্রাকৃতিক জলাশয়। প্রাকৃতিক জলাশয়ে নিবন্ধিত জেলে ব্যতিত অন্যদের মাছ ধরা নিষেধ। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ডাকাতিয়া নদীতে ভেসাল উচ্ছেদকরণ, কারেন্টজাল জব্দে অভিযান পরিচালনা করা হবে’।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মনজুরুল হক জানান, ‘ইতোমধ্যে চৌদ্দগ্রামের বেশ কয়েকটি স্থানে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে বসানো জাল এবং বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে। ছোট-বড় নদীগুলোতেও পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে স্থাপিত ভেসাল ও চুঙ্গিজালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে’।