ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ঃ আনন্দ-বেদনার কাব্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ঃ আনন্দ-বেদনার কাব্য

শাহেদ ইকবাল।।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহসিন হলের সেই ক্যান্টিনের কথা মনে আছে? এই ক্যান্টিনের নাম ছিল পাটোয়ারীর ক্যান্টিন। এই ক্যান্টিনের পরোটা নিয়ে আমরা অনেক মজা করতাম। কেউ বলতাম ‘ডানলপের টায়ার’। কেউ বলতাম, ‘পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পরও এই পরোটা আরও আড়াই মিনিট থাকবে।’ এই ক্যান্টিনে নাস্তা করতে গিয়ে রুমমেট-হলমেটদের সাথে তুমুল আড্ডা জমে যেতো। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে এই পাটোয়ারীর ক্যান্টিন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম অর্থনীতি বিভাগে (১৯৮১-৮২)। থাকতাম হাজী মুহসিন হলের ৪২৯ নম্বর কক্ষে। সেই কক্ষে আমার রুমমেট ছিলেন ইতিহাস বিভাগের কাজী ফরহাদ (বিচিত্রা খ্যাত কাজী জাওয়াদের অনুজ। বর্তমানে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মাহবুবুর রহমান (বর্তমানে জেলা জজ, নীলফামারী) ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কাভি নাসের (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী)। কাজী ফরহাদ চমৎকার কবিতা লিখতেন। কাভি নাসের গিটার বাজিয়ে গান করতেন। মাহবুব আমাদের সকল সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহ ও প্রেরণা দিতেন।

ছাত্রজীবনে হোস্টেলে থাকার কিছু কমন অভিজ্ঞতা আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো রুমের মধ্যে চাবি রেখে ভুলবশত তালা মেরে দেওয়া। এই অভিজ্ঞতা আমারও একাধিকবার হয়েছিল। তারমধ্যে একদিনের অভিজ্ঞতা ভুলবার নয়। তাড়াহুড়ার মধ্যে শার্ট বদল করে অন্য শার্ট গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছি। রুমের চাবি রয়ে গেছে আগের শার্টের পকেটে। ওদিকে তিনজন রুমমেটই ঢাকার বাইরে। এই রাতের বেলায় চাবিওয়ালাও পাওয়া যাবে না। এখন উপায়?

বাধ্য হয়ে পাশের ৪৩০ নম্বর রুমে গেলাম। উপায় নেই। সেই রুমের জানালা দিয়ে নেমে কার্নিশ বেয়ে নিজের রুমে যেতে হবে। সেই ৪৩০ নম্বর রুমেও থাকতেন চারজন। এহেন প্রস্তাবে চারজনই আপত্তি জানালেন। পাগল না মাথা খারাপ? আমি যদি জানালা দিয়ে নামতে গিয়ে নিচে পড়ে যাই, তারপর মরে-টরে যাই, এই দায়দায়িত্ব কে নেবে? তখন তো হয়তো খুনের মামলায় ফাঁসতে হবে। অসম্ভব। এই প্রস্তাব বাতিল।

শেষমেষ ফয়সালা হলো। আমি একটা সাদা কাগজে লিখবো-‘আমার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নয়।’ সেই কাগজ ৪৩০ নম্বর রুমের রুমমেটদের কাছে দিয়ে দেব। তারপর জানালা দিয়ে ঝাঁপ দেব।

শেষমেষ এই নাটক কোথায় গিয়ে গড়াতো বলা মুশকিল। কিন্তু বাদ সাধলো সেই চাবি। সেই হারিয়ে যাওয়া চাবি। দেখা গেল চাবিটা আসলে রুমে ফেলে আসিনি। ফেলে এসেছি অন্য জায়গায়। কেউ একজন সেই চাবি খুঁজে পেয়েছে। ব্যাস। জানালা দিয়ে দড়ির সার্কাস আর দেখানো লাগলো না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি মানেই আনন্দবেদনার কাব্য। আমার শিক্ষাজীবনেই ঘটেছিল জগন্নাথ হলের সেই ট্র্যাজেডি। ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর জগন্নাথ হলের ছাদ ধ্বসে মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল ৪০ জন শিক্ষার্থীর। আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিনে গভীর শোকের সাথে নিহতদের স্মরণ করা হয়। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। দুর্ঘটনা যে কত শোকাবহ হতে পারে তা চাক্ষুস না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

হাজী মুহসিন হল ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একটি বিবর্তন কেন্দ্র। এখানে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উভয় প্রকার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হতো। সকাল ৯-০০টায় নিয়মিত সমসাময়িক বিষয়াদির উপর মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা হতো। আমার সময়ে হাজী মুহসিন হলের প্রভোস্ট হিসেবে প্রথম যাঁকে পেয়েছিলাম তিনি হলেন প্রথিতযশা কবি, গীতিকার ও কথাসাহিত্যিক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। হাউস টিউটর ছিলেন বিশিষ্ট কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত।

১৯৮৬ সালে জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতার সিলেকশন রাউণ্ডে প্রথম হয়ে মুহসিন হলের টিম লিডার নির্বাচিত হই। সে সময় আমাদের (বিতর্ক টিমের সদস্যদের) প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধ উচ্চারণ শেখানোর জন্য অধ্যাপক ড. নরেন বিশ্বাসকে কিছুদিনের জন্য আমাদের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। তিনি নিয়মিত মুহসিন হলে এসে আমাদের বাংলা উচ্চারণ রীতি শেখাতেন যা থেকে আমরা বিশেষভাবে উপকৃত হই। যে নামগুলো বললাম, তাঁদের মধ্যে একমাত্র ড. আবুল বারকাত ছাড়া অন্যরা কেউ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। আজ এই সুযোগে গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাঁদের স্মরণ করছি।

আমাদের সময়ে মুহসিন হলের কিছু কিছু কক্ষে নিয়মিত শিল্প সংস্কৃতির আসর বসতো। তেমনই একটি কক্ষ ছিল ৩৫৭ নম্বর কক্ষ। এই কক্ষে থাকতেন ইংরেজি বিভাগের জাহাঙ্গীর হাসান ভাই। কক্সবাজারের মানুষ হওয়ার সুবাদে আমরা পূর্বপরিচিত ছিলাম। তাঁর ছিল চোখ ধাঁধানো বইয়ের সংগ্রহ; শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ। মান্না দে’র বিখ্যাত সেই কফি হাউসের আড্ডার মতো এই কক্ষে আমরা ক’জন নিয়মিত জড়ো হতাম। আমাদের মধ্যে থাকতেন সৈয়দ লুৎফুল কবীর, সমাজবিদ্যা বিভাগের আরিফ উল মওলা (তিনিও কক্সবাজারের মানুষ, সম্পর্কে আমার জেঠতুত ভাই)। সার্জেন্ট জহুরুল হক হল থেকে আসতেন অকল্পনীয় মেধা ও মননের অধিকারী ইকবাল শাইলো ভাই। অন্য একজন শিল্পী গিটার বাজিয়ে গান ধরতেন, ‘মুর্শিদ আমার মন ভাঙিয়া পিঞ্জর বানাইছে।’ গানটি তখন প্রচণ্ড জনপ্রিয়। এই শিল্পীর নামটি মনে পড়ছে না। জাহাঙ্গীর হাসান ভাই সেই নামটি বিস্মরণ থেকে উদ্ধার করে দিতে পারেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে লেখালেখির সুবাদে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হই। মুক্তকণ্ঠ আবৃত্তি একাডেমী থেকে আবৃত্তির উপর কোর্স করি। বিভিন্ন ভক্তজনের কাছ থেকে চিঠিপত্র পেতেও শুরু করি। স্বজন-প্রিয়জনের বাইরে কারও কাছ থেকে পত্র পাওয়ার সেই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। পেনফ্রেন্ডশিপ নামক একটি শব্দের সাথেও প্রথম পরিচিতি। এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম নারী বৈমানিক ক্যাপ্টেন রোকসানা ১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে রোকসানা স্মৃতি সংসদ থেকে ‘মাসিক রোকসানা’ নামক একটি নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। সেই পত্রিকায় লেখা জমা দিতে গিয়ে সম্পাদকমণ্ডলির সুনজরে পড়ি। তারা সম্পূর্ণ নারী পরিচালিত সেই পত্রিকার নীতিমালা ভেঙে আমাকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। শিল্পসাহিত্যের অভিযাত্রায় কোনো নারীবাদী আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাও আমার জীবনে সেই প্রথম। এখানে আরও একটি প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য। ‘মাসিক রোকসানা’ পত্রিকায় কর্মরত থাকার সময়ই স্বামীবাগের ‘জাগো ললিতকলা কেন্দ্রে’ রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগে ভর্তি হয়ে যাই। সেখানে ওস্তাদ সমীর চক্রবর্তীর কাছ থেকে দুই বছর সঙ্গীতের উপর তালিম গ্রহণ করি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি এত ক্ষুদ্র পরিসরে লিখে শেষ করা যায় না। আজ মজার একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করবো। এক বিকেলের ঘটনা। চারুকলা বকুলতলা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। চারপাশে সবুজের সমারোহ। তারমধ্যে একদল চিত্রকর ছবি আঁকছেন। দেখলে মনে হবে একদল মুনী ঋষি ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছেন। পাশের ফুটপাতে নানা শ্রেণীর শিক্ষার্থীগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপে জটলা করছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সবাই গল্প থামিয়ে আমাকে দেখছেন। কেউ কেউ ছবি আঁকা বন্ধ করে আমাকে দেখছেন। নারীপুরুষ নির্বিশেষে গভীর কৌতূহলে আমাকে দেখছেন। ব্যাপার কি?

ঘটনাচক্রে আমার গায়ে নতুন জামা। সেটা নিশ্চয়ই এমন কৌতূহলের কারণ হতে পারে না। আমি দেখতেও আহামরি কিছু নই। আমার মা ছিলেন অসামান্য রূপবতী। আমি মায়ের রূপ পাইনি। সাধারণ মানুষের সাধারণ যে রূপ, তাও পাইনি। কোনো বিখ্যাত লোকের সাথেও আমার চেহারার কোনো মিল নাই। অনেক গবেষণা করে দেখেছি, দার্জিলিংয়ের হনুমানের সাথে আমার চেহারার কিঞ্চিত মিল আছে। তাহলে? আমাকে এমন কৌতূহলের সাথে দেখার কারণ কি?

আসলে ওটা ছিল কাকের শিল্পকর্ম। এত নিপুণ শিল্পকর্ম যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। চারুকলায় অনেক গাছ, অনেক কাক। গুণী মানুষের শিল্পকর্ম দেখে সেই কাক হয়তো প্রভাবিত হয়ে থাকবে। প্রভাবিত হয়ে আমার জামায় এই শিল্পকর্ম করে থাকবে। অন্যমনস্ক থাকায় টের পাইনি। শেষপর্যন্ত আবিষ্কার করলাম, আমাকে দেখে নয়, সেই শিল্পকর্ম দেখেই চারপাশের মানুষ এমন মুগ্ধ হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে আজও টানে। আজও বইমেলার ফাঁকে টিএসসির কড়া লিকারযুক্ত চা ও ঝালমুড়ির সাথে প্রাণের মায়ায় জড়িয়ে যাই। আজও কোনো সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালার ডাক পেলে প্রথম ডাকেই হাজির হয়ে যাই। ২০১৮-২০১৯ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এমন একাধিক অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছি। অতিমারী করোনার কারণে বর্তমানে সাময়িক বিরতি চলছে। শীঘ্রই সেই বিরতি ভেঙে আবারও প্রিয় ক্যাম্পাস প্রাণের মেলায় মুখরিত হয়ে উঠবে এটা যেমন আমার প্রত্যাশা, তেমনি অগণিত সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীর হৃদয়ের ঐকান্তিক প্রত্যাশা। অগণিত মানুষের মিলিত প্রত্যাশা কখনও বিফল হতে পারে না। জেগে থাকুক প্রিয় ক্যাম্পাস। জেগে থাকুক প্রিয় বিদ্যায়তন। জেগে থাকুক প্রাচ্যের অক্সফোর্ড।

আরো পড়ুনঃ