ভারত-পাকিস্তান ভাগ কী জরুরি ছিল?

ডেস্ক নিউজ। 

উত্তরে হিমালয় পর্বত। পশ্চিমে হিন্দুকুশ ও পূর্বে আরাকানি পর্বতমালা। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। এর মধ্যকার অঞ্চলটির ভৌগোলিক পরিচিতি দক্ষিণ এশিয়া হিসেবে। যুগ যুগ ধরে একে ভারতীয় উপমহাদেশ হিসেবেও লেখা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাদেশ এশিয়ার দক্ষিণ অংশে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা- এই ৭টি দেশ নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ গঠিত। ভারতীয় উপমহাদেশভুক্ত না হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে পরিচিত আফগানিস্তান।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫ ভাগের ১ ভাগ বাস করে ভারতীয় উপমহাদেশে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ঐতিহাসিক নানা কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের আলোচিত দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ।

ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের পদার্পণ প্রথম হয় আনুমানিক ৭৩ থেকে ৫৫ হাজার বছর আগে। ইরান থেকে একটি শিকারি জাতি এ মহাদেশে আগমন করে। তবে এ এলাকায় মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছে ৯ হাজার বছর আগে।

যদিও বর্তমানের পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে ইন্দাস ভ্যালি বা সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ শুরু হয় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে। তখন ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘতম খরার কারণে নগর এলাকা থেকে মানুষ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। যে খরা ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, লোহিত সাগর এলাকা, আরব উপদ্বীপ এবং উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত।

সেসময় মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে বসবাসকারী ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়ার পাঞ্জাবে পাড়ি জমায়। পাঞ্জাব থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এ ইন্দো-আর্য জাতি।
শাসনামলে ভারতে তাজমহলসহ ঐতিহাসিক নানা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়।

১৭৪৮ সালে মুঘলদের ১৩তম শাসক মোহাম্মদ শাহ-এর শাসনামলে দুর্বল হয়ে পড়ে মুঘল সাম্রাজ্য। এরপর মারাঠা, শিখ, মহীসূর, নিজাম এবং বাংলার নবাবরা ভারতীয় উপমহাদেশের একটা বড় অংশকে শাসন করেন।

১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু করে। ১৯০০ শতকের মাঝামাঝিতে ভারতের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশ কোম্পানির অধীনে চলে যায়।

ভারতীয়দের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সভা-সমাবেশের অধিকার দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা, কর্মক্ষেত্রে ভারতীয়দের নিয়োগ নিশ্চিত করা, প্রশাসনিক অপব্যবহার দূর করাসহ প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সংস্কার করা, ভারতীয়দের থেকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করাসহ সাংবিধানিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ সম্পদের দাম বাড়াতে ব্রিটিশ সরকারের নেওয়া নীতির সংস্কার করা, ভারতের জনগণের কল্যাণে আধুনিক শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করা, লবণের ওপর কর বাদ দেওয়ার অর্থনৈতিক নীতিসহ বেশ কিছু প্রস্তাব পাস করে কংগ্রেস।

১৯১৯ সালে ১৮ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের আইনসভা ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বিরোধী রাওলাট আইন পাস করে। যে আইনে বিনা বিচারে গ্রেপ্তার ও বন্দি রাখার আইন পাস হয়।

এ আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিওয়ানওয়ালাবাগে ১৯১৯ সালের ১৩ মার্চ ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এডওয়ার্ড হেরি ডায়ারের নেতৃত্বে গুলি চালায় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী। ওই ঘটনায় ১৫০০ জন নিহত হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৯২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ভারতীয়দের স্বাধিকারের দাবিতে কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন।

এ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতার পথে বড় ভূমিকা রেখেছে। যদিও কংগ্রেসে নেতাদের অধিকাংশই হিন্দু ধর্মের হওয়ায় মুসলমান নেতাদের মাঝে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষোভ ছিল।

১৯০৫ সালে বাংলা প্রদেশের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমাঞ্চল এবং মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাংশকে আলাদা করে বাংলাকে দুই ভাগ করা হয়। এ ভাগের কারণে পূর্ব বাংলায় হিন্দুদের প্রভাব কমে যাওয়ায় হিন্দুদের একটি বড় অংশ এ বিভক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু করে। ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ ভারতে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে মুসলমানদের আলাদা রাজনৈতিক দল হিসেবে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ গঠিত হয়। ঢাকার চতুর্থ নবাব খাজা সলিমুল্লাহ মুসলমানদের জন্য আলাদা রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাবটি করেন।

১৯৩০ সালে মুসলিম লীগ নেতা স্যার মোহাম্মদ ইকবাল ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব, সিন্ধু,খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তান এই চারটি প্রদেশ এবং ইসলামাবাদ প্রজাতন্ত্র এবং আজাদ জম্মু এবং কাশ্মির ও গিলগিট বালটিস্তান নিয়ে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাভাবনা করেন।

পরবর্তীতে মুসলিম লীগের ১২ বারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ আলী এ ধারণাকে এগিয়ে নেন। যদিও মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের নামটি প্রথম ব্যবহার চৌধুরী রহমত আলী।

যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্বিবিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৩৩ সালের ২৮ জানুয়ারি রহমত আলীর পুস্তিকা নাউ অর নেভার: আর উই টু লিভ অর পেরিশ ফরএভার প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকাতেই প্রথম পাকিস্তান শব্দটি ব্যবহার হয়। যদিও তখন- এই লেখাকে একজন ছাত্রের প্রস্তাব হিসেবে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

১৯৪০ সালের মধ্যে বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়-যে হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে যদি একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমরা নানা বৈষম্যের শিকার হবে।

জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালের ২২ থেকে ২৪ মার্চ লাহোরে তিনদিনের সম্মেলনে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তুলে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় যা-লাহোর প্রস্তাব নামে পরিচিত ।

এ প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা নিয়ে মুসলমান রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। ভারত-পাকিস্তান এক থাকার সময়ে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনাকে ভারত ভাগ হওয়ার পেছনের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

১৯৪৭ সালে জিন্নাহর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তবে পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে পাকিস্তানের অংশ থাকা পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।তথ্য সূত্র দেশ টিভি অনলাইন

আরো পড়ুনঃ