জঙ্গিবাদের মতো উগ্র মতাদর্শ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ৯ জঙ্গি সদস্য। র্যাবের নতুন উদ্যোগ ডি-রেডিক্যালাইজশেন প্রক্রিয়ার আওতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন তারা। আজ র্যাবের কাছে তারা আত্মসমর্পণ করেন।
র্যাব বলছে, বিশ্বের অন্য দেশের মতো জঙ্গিদের সঠিক প্রক্রিয়ায় ডি-রেডিক্যালাইজেশন করে জঙ্গিবাদ থেকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন তারা। দীর্ঘ সময় কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের উগ্র আদর্শকে ধ্বংস করা হয়েছে। এমন ৯ জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছেন। এদের মধ্যে প্রকৌশলী-চিকিৎসক স্বামী-স্ত্রীসহ আছে নব্য ও পুরাতন জেএমবির সদস্যরা রয়েছেন।
আত্মসমর্পণ করা ব্যক্তিরা হলেন, শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত।
তিনি সিলেটের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে হিযবুত তাহরীরে যুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি সংগঠনের বিশ্ববিদ্যারলয় শাখার শীর্ষ পর্যায়ে চলে যান। ২০০৯ সালে আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। তিনি ২০১১ সালে মেডিকেল শিক্ষার্থী নুসরাতকে বিয়ে করেন। স্ত্রী নুসরাতও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। পরবর্তীতে সংগঠনের নির্দেশনায় তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ২০১৭ সাল থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো অভিযানে গ্রেপ্তার আতঙ্কে তিনি ঢাকাতে বিভিন্ন জায়গায় বাসা বদল করেন। একপর্যায়ে ঢাকার আশপাশের এলাকায় বসবাস শুরু করেন।
ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯)। সিলেটের একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজের ছাত্রী থাকায় আনসার আল ইসলাম-এর সদস্য শাওনের সাথে বিয়ে হয়। এ বিয়ে সাংগঠনিক অনুমোদনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। মূলত স্বামী শাওন তাকে উগ্রবাদের দিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। স্বামীর সাথে তিনি সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেন। জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়ার কারণে ঢাকায় কয়েকটি হাসপাতালে পরিচয় গোপন করে তাকে খন্ডকালীন চাকুরি করতে হয়েছে। জঙ্গিবাদের অনুসারী হওয়ার কারণে শাওন ও ডা. নুসরাতকে দীর্ঘদিন ফেরারী জীবনযাপন করতে হয়। এতে তাদের দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সৃষ্টি হয় দুরত্ব। তাদের পারিবারিক জীবনে অশান্তির সূত্রপাত হয়। এক পর্যায়ে তারা ভুল বুঝতে পারেন। ফলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তারা র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। শাওন অসমাপ্ত শিক্ষা জীবন সম্পূর্ ও ডা. নুসরাতকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূর্নবাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
আরেকজন আবিদা জান্নাত আসমা (১৮)। উগ্রবাদে আকৃষ্ট হওয়ার পর পিতামাতার কাছে গোপন করে ২০১৮ সালে আনসার আল ইসলামের এক সদস্যের সাথে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শুরু হয় স্বামীর সাথে আত্মগোপনের জীবন। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ায় তিনি আত্মগোপনে থেকে ফেরারী জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। ফলে স্বজনের কাছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। শাওনের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নেন।
মো. সাইফুল্লাহ (৩৭) মাদ্রাসায় অধ্যায়নকালীন তার সহপাঠীর মাধ্যমে জেএমবির সাথে যুক্ত হন। তিনি দাওয়াতি কার্যক্রম ও অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তার কিছু সঙ্গী গ্রেপ্তার হওয়ার পর পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। ফেরারী জীবনের কারণে তার পারিবারিক জীবনে অশান্তি শুরু হয়। তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং একপর্যায়ে ভুল বুঝতে পারেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
এদের মধ্যে আরেকজন মোহাম্মদ হোসেন (২৩), পেশায় রাজমিস্ত্রি। ২০১২ সালে ঢাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজে নিয়োজিত হন। সাইফুল্লাহ তাকে জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি সাইফুল্লার সাথে জেএমবির সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যান। কিন্তু ফেরারী জীবনের অনিশ্চয়তায় ও পারিবারিক জীবনে অশান্তির কারণে এক পর্যায়ে তার ভুল বুঝতে পারেন। তিনি সাইফুল্লাহ’র সাথে আলোচনা করে র্যাবের সাথে যোগাযোগ করেন। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
মো. সাইফুল (৩১) ২০১৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাস করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি জেএমবিতে যোগ দেন। নিজ এলাকায় ব্যাপক সাংগঠনিক কার্যক্রম চালান। জঙ্গি হিসেবে তিনি এলাকায় পরিচিতি পান। ইতিমধ্যে জঙ্গি সংগঠনের কিছু সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়ায় আত্মগোপনে চলে যান। তাকে দীর্ঘদিন বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে হয়। তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এবং মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এরপর জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে র্যাবের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তিনি আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন (২৬) ও মো. সাইদুর রহমান (২২) উগ্রবাদী ভিডিও দেখে জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। নিজ এলাকার একটি বাড়িতে তারা বায়াত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তারা ঢাকায় এসে আত্মগোপন করেন। জঙ্গি বিরোধী অব্যাহত অভিযানে তাদের অনেক সঙ্গী আত্মগোপনে চলে যান। ফলে সঙ্গীদের সাথে তারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরিবার নিকট আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে নিজ বাড়িতেও অবস্থান করতে পারেন না। আত্মগোপনে থেকে তারা উপলব্দি করেন- এ জীবন কোন সুস্থ্য মানুষের জীবন হতে পারে না। পরে তিনি এমন স্বিদ্ধান্ত নেন।
আবদুর রহমান সোহেল (২৮)। পেশায় শিক্ষক। তিনি জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি জঙ্গি মামলাতে গ্রেপ্তার হন। ২০১৮ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে পূনরায় জঙ্গি সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। তবে তার বিরুদ্ধে পূনরায় ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ায় আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু তার এই ফেরারী জীবনে পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে দুরত্ব তৈরি হয়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। পরে ভুল বুঝতে পেরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে উদ্যোগী হয়ে র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।
র্যাব বলছে, উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িত প্রথম তিন ধাপের ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিয়েছেন তারা। যখন কেউ জঙ্গি বা উগ্রবাদী হয়, তখন সে প্রথম দিনেই জঙ্গি হয়ে যায় না। ৫ ধাপ শেষ করে একজন ব্যক্তি পূর্ণ জঙ্গিতে পরিণত হয়। প্রথম ধাপে তারা ওই জঙ্গি সংগঠনের প্রতি সহমর্মিতা দেখায়। দ্বিতীয় ধাপে সে হয়ে যায় ওই সংগঠনের সমর্থক। তারপর সে হয় অ্যাক্টিভিস্ট। এ পর্যায়ে সে বিভিন্ন কার্যকলাপে অংশ নেয়। চাঁদা আদায় করে, দাওয়াত দেয়। তারপর সে হয় এক্সট্রিমিস্ট। নিজের ভেতর উগ্রবাদ ধারণ করে। শেষ পর্যায়ে গিয়ে সে পরিবার-জগত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়। অস্বাভাবিক একটা জীবন যাপন শুরু করে। বায়াত গ্রহণ করে। আর যখন বায়াত গ্রহণ করে তারপর তারা জঙ্গিবাদে লিপ্ত হয়ে যায়। প্রথম তিন পর্যায়, সংগঠনের প্রতি সহমর্মিতা, সমর্থন এবং অ্যাক্টিভিস্ট যারা আছেন, তাদের নিয়ে কাজ করছে র্যাব। তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরত আনার চেষ্টা করছে। মূলত সরকারের পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় র্যাব তাদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে এখানে সফলতা পাওয়ার পর এটি স্থায়ী রূপ দিতে কাজ করছে র্যাব। সমাজে পুনর্বাসিত করার জন্য তাদের ডি-রেডিক্যালাইজেশন করবে। আর তার জন্য র্যাব সদস্য, শিক্ষক, আলেমদের নিয়ে একটা টিমও গঠন করেছে এই এলিট ফোর্স। ‘নব দিগন্তে প্রত্যাবর্তন’ এই স্লোগানের মধ্যে দিয়ে র্যাব সদর দপ্তরের আজাদ মেমোরিয়াল হলে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে অংশ নেন একাডেমিশিয়ান, ইসলামি স্কলার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিশিষ্ট নাগরিকেরা। প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এছাড়া পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদও উপস্থিত ছিলেন।