নিজস্ব প্রতিবেদক, কুমিল্লা ।।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত মারা গেছেন। তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় , সিঙ্গাপুর সময় রাত সাড়ে ৮ টায় । ইন্না নিল্লা হে ওয়া ইন্না ইলাহির রাজিউন। তারঁ মৃত্যু সংবাদে শোকের ছায়া নেমে আসে নগর জুড়ে।
কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গত রোববার বিকেলে তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়।
জানা গেছে, গত বুধবার অক্সিজেন সেচ্যুরেশন কমে যাওয়ায় মেয়র রিফাতকে ঢাকায় শ্যামলীতে অবস্থিত বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত গত বছর ১৫ জুনের নির্বাচনে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে ৫০ হাজার ৩১০ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে জয়ী হন তিনি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল ইসলাম সাক্কু পান ৪৯ হাজার ৯৭৬ ভোট। সাক্কুর চেয়ে ৩৪৩ ভোট বেশি পেয়ে কুমিল্লা সিটির নতুন মেয়র নির্বাচিত হন রিফাত।
তিনিই কুমিল্লা সিটিতে প্রথমবার আওয়ামী লীগ থেকে বিজয়ী মেয়র
পারিবারিক জীবন
আরফানুল হক রিফাত ১৯৫৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম এস এম আতাউল হক মায়ের নাম হাছিনা হক। দুই জনই গত হয়েছেন। পাঁচ বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ৬ষ্ঠ। আরফানুল হক রিফাতের বড় ভাই রেজোয়ান আরিফুল হক (কিন্টু) একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ যোদ্ধা। তাঁর পিতা তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কর্মকর্তা। তাঁর ছোট চাচা মাহবুবুল হক পেয়ারা ছিলেন ফেনী পৌরসভার প্রশাসক, ফেনী প্রেস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ও ফেনী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর বড় চাচা ওবায়দুল হক সাহেব ছিলেন বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক।
স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধু যখন প্রথম জাতিসংঘে যান ওবায়দুল হক সাহেবকে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সফর সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যান। ওবায়দুল হক সাহেব জাতির জনকের জীবদ্দশায় ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধুর উপর Voice of Thunder, (বজ্রকন্ঠ), Bangabandhu Sheik Mujib: A Leader with a Difference গ্রন্থসমূহ রচনা করেন। তাঁর দাদা খাঁন সাহেব বজলুল হক ছিলেন অবিভক্ত বাংলায় বঙ্গীয় গণপরিষদের সদস্য। ফেনী কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সেক্রেটারী এবং বৃহত্তর নোয়াখালীর জেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান।
আরফানুল হক রিফাত ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর স্ত্রী ফারহানা হক শিল্পী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক।
আরফানুল হক রিফাত তিন সন্তানের জনক। বড় মেয়ে তাসফিয়া রিফাত আহসানউল্লাহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এর ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে আইএফআইসি ব্যাংকে কর্মরত। ছোট মেয়ে সামিহা রিফাত সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। বর্তমানে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত। একমাত্র ছেলে এহতেশামুল হক আর্মড ফোর্স মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস- এ অধ্যায়নরত।
আরফানুল হক রিফাত ১৯৯৪ সালের ২১শে ডিসেম্বর কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য হন। ২০১০-২০১১ ও ২০১২-২০১৩ সালে টানা দুই মেয়াদে কুমিল্লা ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি কুমিল্লা ক্লাবের সহ-সাধারণ সম্পাদক সহ কার্যনির্বাহী কমিটির বিভিন্ন পদে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালে কুমিল্লা ক্লাবের শতবর্ষপূর্তি উৎসব উদযাপন কমিটির আহবায়ক ছিলেন আরফানুল হক রিফাত। তাঁর নেতৃত্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা ও কুমিল্লার ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে দেশ বিদেশের শিল্পী, তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী খ্যতিমান অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, এমপি মহোদয়কে অতিথি করে শতবর্ষ উৎসব উদযাপন করা হয়। কুমিল্লা-৬ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিনের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনায় আরফানুল হক রিফাত কুমিল্লা ক্লাবকে এগিয়ে নিয়ে যান আরফানুল হক রিফাতের সময়ে কুমিল্লার তরুণ ছেলেরা কুমিল্লা ক্লাবে সদস্য হন। তার সময়ে ক্লাবের সর্বক্ষেত্রে গতিময়তা বৃদ্ধি পায়।
আরফানুল হক রিফাত কুমিল্লা জেলা ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় ছিলেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত সময়ে কলেজ ক্রিকেট দলের নিয়মিত ক্রিকেটার ছিলেন। কলেজ ক্রিকেট দলের পক্ষে কুমিল্লা জেলা ক্রীড়া সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে নিয়মিত খেলতেন।
২০০৮-২০২০ সাল পর্যন্ত টানা চার মেয়াদে আরফানুল হক রিফাত কুমিল্লা জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ২০০৮ থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কাউন্সিলর।
২০০৮ সাল থেকে কুমিল্লা জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যকরি কমিটির সহ-সভাপতি। কুমিল্লা জেলা ক্রীড়া সংস্থার অন্তর্ভুক্ত শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র ক্লাবের সভাপতি।
২০১৬ সাল থেকে আরফানুল হক রিফাত কুমিল্লা মডার্ণ হাই স্কুলে পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাঁর সময়ে কুমিল্লা মডার্ণ হাই স্কুলে শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ ও স্কুলের অর্থনৈতিক সৎক্ষমতার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে।
আরফানুল হক রিফাত কুমিল্লা ভাষাসৈনিক অজিতগুহ কলেজ ও কুমিল্লা মহিলা কলেজের দাতা সদস্য। তিনি কুমিল্লা ডায়াবেটিক সমিতি ও বাংলাদেশ অন্ধ কল্যাণ সমিতির সদস্য।
রাজনৈতিক জীবন
আরফানুল হক রিফাত ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ১৯৭৭-১৯৭৮ সালে কুমিল্লা শহর ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮১ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের বহিঃক্রীড়া ও ব্যায়ামাগার সম্পাদক ছিলেন।
১৯৯৬ সালে কুমিল্লা জেলা যুবলীগের সিনিয়র সহ সভাপতির দায়িত্ব নেন। একই বছর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন।
২০১৭ সালে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান আরফানুল হক রিফাত। অদ্যবধি তিনি এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ২০২২ সালের ১৩ই এপ্রিল কুমিল্লা মহানগর আওয়ামীলীগ ও দলীয় সকল অঙ্গসংগঠন সর্বসম্মতিক্রমে একক প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে আরফানুল হক রিফাতকে দলীয় প্রার্থী করার প্রস্তাব পেশ করেন।
২০২২ সালের ১৩ই মে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড সভায় আরফানুল হক রিফাতকে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়।
রাজনীতি করতে গিয়ে আরফানুল হক রিফাত প্রতিহিংসার শিকার হন। ১৯৮১ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পর ছাত্র সংসদ কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙ্গানোর কারণে ১ জানুয়ারি ১৯৮২ সালে জামায়াত শিবিরের সাথে সংঘর্ষ হয়। ঐ সংঘর্ষের সময় আরফানুল হক রিফাতের হাত ও পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয় এবং মাথায় আঘাতের কারণে ৩২টি সেলাই লাগে। চিকিৎসাকালীন সময়ে ১৮ পাউন্ড রক্ত দেওয়া হয়। দেশের কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা করেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়।
২০২২ সালের ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রথমবার মেয়র পদে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে জয়ী হন। ১৬ জুন সরকারিভাবে আরফানুল হক রিফাতকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
২৩ জুন বাংলাদেশ গেজেটে আরফানুল হক রিফাতের নাম মেয়র হিসেবে প্রকাশিত হয়।
৫জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরফানুল হক রিফাতকে শপথ বাক্য পাঠ করান।
৬ জুলাই তিনি কুমিল্লা সদর আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের নেতৃত্বে দলীয় সকল অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ সহ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
৭ জুলাই নগর ভবনে গিয়ে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে মেয়রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।