ডেস্ক নিউজ।।
সময় যত গড়াচ্ছে মানুষের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি, ভালোবাসা, হৃদ্যতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি উঠে যাচ্ছে। দেশ যত ডিজিটাল হচ্ছে দিন দিন মানুষ ততটাই আত্মকেন্দ্রিক ও হিংস্র হয়ে উঠছে। বড়রা ছোটদের, ছোটরা বড়দের যেন সম্মান, শ্রদ্ধা দেখাতে বিস্মৃত হয়েছে। মুসলিম সমাজ এ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।
কারণ আমরা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। নবীগণের নেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত। আমাদের এ বৈশিষ্ট্য পবিত্র কোরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত।
মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন, যার অনুবাদ হচ্ছে, “তোমরা সর্বোত্তম উম্মত। তোমাদেরকে মানবকল্যাণ সাধনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর আল্লাহর ওপর পূর্ণ ঈমান রাখবে।” (সূরা: আল ইমরান, আয়াত: ১১০)
যদিও এই দায়িত্ব বিগত উম্মতগুলোর ওপরও অর্পিত ছিলো। কিন্তু পূর্ব উম্মতরা এই মহান দায়িত্বের প্রতি মনোযোগী হয়নি। নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে আদায় করেনি বরং গুরুত্বহীনভাবে পেছনে ফেলে রেখেছে। ফলে মহান আল্লাহ সেই জাতির ওপর অভিশাপ করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধির উপায় কী? কল্যাণ সাধনের প্রক্রিয়া কী তা নিয়ে।
আমরা যদি কাউকে না চিনি, তার চরিত্র না বুঝি তবে তাকে সদুপদেশ দেবো কি করে?
এর একটি সহজ পন্থা রাসূলে কারীম (সা.) তাঁর জীবন ও কর্মের মাধ্যমে মুসলিম জাতিকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। যার চর্চার মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরাম সমগ্র বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিলেন। আর তা হচ্ছে ‘সালাম’ বা পারস্পরিক অভিবাদন।
এটি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্ভাষণ, সর্বোত্তম অভ্যর্থনা, যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং একটি গণদোয়া। ‘সালাম’ ইসলামী সংস্কৃতির প্রথম অংশ এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। সালামের ব্যাপক প্রচলন এবং এটাকে ইবাদত হিসেবে নেয়ার জন্য কুরআন ও হাদিসে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যখন তোমাদেরকে কেউ অভিবাদন (সালাম) জানায় তখন তাকে তার চেয়েও উত্তম পদ্ধতিতে জবাব দাও অথবা তার মতো করে। আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী। (সূরা নিসা : ৮৬)
পৃথিবীর আদি মানব ও পিতা আদম (আ.) থেকেই সালামের প্রচলন শুরু হয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, আদমকে সৃষ্টির পর আল্লাহ তাআলা বলেন, যাও এবং ফেরেশতাদের দলটিকে সালাম করো। তারা সালামের যে উত্তর দেবে তাই হবে তোমার ও তোমার সন্তানদের সালাম আদান-প্রদান পদ্ধতি (সংক্ষেপিত), (বুখারি ও মুসলিম)।
সালাম ঈমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ইবাদত।
সালামের সঙ্গে ঈমানের সম্পর্ক সুস্পষ্ট। হযরত আম্মার (রা) বলেন, যে ব্যক্তি তিনটি সৎ গুণ অর্জন করে, সে পূর্ণ ঈমান লাভ করে। যেমন, নিজের ব্যাপারে ইনসাফ করা, সালাম প্রদান করা এবং অভাবগ্রস্ত অবস্থায়ও দান করা। (বুখারি : ২৬)
পৃথিবীতে প্রতিটি সভ্য জাতির মাঝে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি প্রকাশার্থে কোনো না কোনো বাক্য আদান-প্রদান করা হয়। কিন্তু তুলনা করলে দেখা যাবে, ইসলাম প্রবর্তিত ‘সালাম’ পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি সুন্দর, যথাযথ, যথার্থ ও ব্যাপকার্থবোধক। এর মধ্যে রয়েছে ভালোবাসা, সম্মান প্রদর্শন, শুভকামনা ও নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয়।
জিকির হিসেবে সালাম : সালামের মধ্যে আছে আল্লাহর জিকির, অন্যকে আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়া, মুসলিম ভাইয়ের প্রতি সম্প্রীতি প্রদর্শন, তার জন্য হিতাকাঙ্ক্ষা এবং তার সঙ্গে এই চুক্তি করা যে, আমার হাত ও মুখ থেকে তুমি নিরাপদ।
জান্নাতিদের সম্ভাষণ : জান্নাতিদের অভিবাদন হবে সালাম। এটি মৃত্যুর ফেরেশতার সম্ভাষণ এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ভালোবাসা প্রদর্শনেরও ভাষা। একজন জান্নাতি যখন জান্নাতে প্রবেশ করবেন, তখন ফেরেশতামণ্ডলী তাকে সালামের মাধ্যমে অভ্যর্থনা ও অভিবাদন জানাবে।
এ বিষয়ে মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘…তারা তাদের পালনকর্তার নির্দেশে তাতে অনন্তকাল থাকবে। সেখানে তাদের সম্ভাষণ হবে ‘সালাম’ (সূরা ইবরাহিম : ২৩)
এ ছাড়া সূরা হিজর, আন নহল, ফুরকান, আহযাব, সাফফাত, যারিয়াতসহ অনেক সূরায় অনুরূপ অভিবাদনের উল্লেখ রয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, মৃত্যুর দূত যখন কোনো মুমিনের প্রাণ-হরণ করবেন, তখন তার প্রতি এই সুসংবাদ পৌঁছানো হয় যে, আপনার পালনকর্তা আপনার প্রতি সালাম প্রদান করেছেন। (রুহুল মাআনী)
কুরআন মাজিদের বহু জায়গায় আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলগণের প্রতি সালাম প্রদান করেছেন (সূরা সাফফাত: ৭৯, ১০৯, ১২০, ১৩০, ১৮১)।
কে কাকে সালাম দেবে : কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী যারা হিদায়াতের অনুসারী তাদের হিদায়াতপ্রাপ্তরা সালাম প্রদান করবে। যারা অমুসলিম তাদেরকে কোনো মুসলিম সালাম প্রদান করবে না। যদি মুসলিম অমুসলিম একসাথে থাকে তাহলে সালাম প্রদানের ভাষাটা হবে ‘আস সালামু আলাইকুম ইয়া মান ইত্তাবাআল হুদা। (সূরা ত্ব-হা: ৪৭)
সালামকে দোয়া ও ভালোবাসা প্রদর্শন এবং একটি ইবাদত হিসেবে দেখলে ছোট বড় নির্বিশেষে সবাই সবাইকে সালাম দেবে বা দিতে পারবে। আর যদি সম্মান, সম্ভাষণ ও অভিবাদনের দিক থেকে দেখা হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে একটি নিয়ম অনুসরণ করার আছে। যেমন জান্নাতবাসী যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন তাদের ফেরেশতারা সালাম প্রদান করবে। এখান থেকে দুটি বিষয় প্রতীয়মান হয়:
এক. যিনি সম্মানি ব্যক্তি তাকে সম্মান প্রদর্শনকারী সালাম দেবে।
দুই. আগন্তুককে অভ্যর্থনা প্রদানকারী সালাম দেবে।
এ ছাড়া পরিবেশ পরিস্থিতি, অবস্থা ও অবস্থান বিবেচনায় সালাম প্রদানের ক্ষেত্রে আরো কিছু নিয়মকানুন আছে। যেমন- কারো বাড়িতে প্রবেশের আগে বাড়ির মালিকের অনুমতি নেয়া ও বাড়ির সদস্যদের সালাম প্রদান করা।
এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! যখন তোমরা অন্য কারো বাড়িতে প্রবেশ করতে চাও, তখন অনুমতি নাও এবং বাড়ির লোকদের সালাম প্রদান করো। (সূরা নূর : ২৭)
রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় আরোহী ব্যক্তি হেঁটে চলা ব্যক্তিকে, পদব্রজে চলাচলকারী ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে এবং কমসংখ্যক লোক বেশি সংখ্যক লোককে, ছোট বা কম বয়সী বয়োজ্যেষ্ঠকে সালাম প্রদান করবে। (বুখারি ও মুসলিম)
তবে এর বিপরীত হওয়াটাও দোষণীয় নয়। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলার কাছে অগ্রগণ্য সে ব্যক্তি যে আগে সালাম দেয়। (তিরমিজি ও আবু দাউদ)
সুতরাং বলা যায়, ভালো কাজের আদেশ, মন্দ কাজে নিষেধ এবং পারস্পরিক সালামের ব্যাপক প্রচলন আমাদের সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে।সূত্র প্রতিদিনের সংবাদ