কুবির উপাচার্যের যত অনিয়ম

কুবির উপাচার্যের যত অনিয়ম

কুবি প্রতিনিধি।।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার বটতলি ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে। তার বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় লেখাপড়া করেন তিনি। উপাচার্য পদে নিয়োগের আগে তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি)র সদস্য থাকাকালীন সময়ে বড় বিতর্কে জড়ান। ২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় আউয়াল নামে একজন প্রার্থী প্রথম হয়েছিলেন, তিনি কী করে প্রথম হলেন- তা নিয়েই পিএসসি সন্দিহান ছিল। বিসিএসে চাকরি পরীক্ষায় প্রথম হয়েও চাকরি না পাওয়া আউয়ালের সাথে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিলেন এই উপাচার্য। প্রশ্ন তুলেছিলেন- আউয়ালের কোনো নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার রেকর্ড নেই। অথচ উপাচার্য নিজেই লক্ষ্মীপুরে কোনো এক সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া শুরু করেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও প্রায় কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা ক্লাবের সদস্য হন। আর লক্ষাধিক টাকা খরচ করে হন কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য। এত টাকার উৎস কোথা থেকে? তাও জানা যায়নি।

একটি সূত্র জানায়, মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর উপাচার্য কুমিল্লা ক্লাবে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি গভীর রাত পর্যন্ত সময় কাটান বলেও জানা গেছে। এছাড়া সার্বক্ষণিক ক্যাম্পাসে থাকার কথা বলা হলেও উপাচার্য অধিকাংশ সময় ঢাকায় থাকেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহার করে ঢাকায় সবজি নেন বলে অভিযোগ করেছেন খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার।

গত ২০ জুন কুবি ভিসি এবং কোষাধ্যক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে কর্মকর্তা পরিষদের এক অনুষ্ঠানে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ দুই কর্তাব্যক্তি। কর্মকর্তা পরিষদের দায়িত্ব হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ড. এমরান কবির চৌধুরী কোষাধ্যক্ষকে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য দিয়েছেন এমন ইঙ্গিত করে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোঃ আসাদুজ্জামান ভিসিকে উদ্দেশ্য করে পাল্টা বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে হ্যামিলনের বাঁশি ওয়ালার গল্প শুনাতে আসি নাই। ন্যায়সঙ্গত কাজ করতে এসেছি। চ্যালেঞ্জে যাবেন! তাহলে যান। আপনার জন্য সবজি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ঢাকায় যেতে হয়। সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার ঢাকায় যেতে হয় আপনাকে সার্ভ করার জন্য। আপনাকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিনিয়ত আপনি আমাকে অপমান করছেন। অপদস্থ করছেন। সহ্য করছি কিছু বলি নাই আপনাকে। আমাকে কর্মচারী ভেবেছেন আপনি? আপনার থেকে কম লেখাপড়া করেছি? আপনার থেকে কম গবেষণা জানি? আপনার সাথে আমি একদিনের জন্য উচ্চবাচ্য করিনি। দিনের পর দিন উপাচার্য আমাকে ইনসাল্ট করেছেন। কেন? আপনি আজকেও সেই একই কথা বলার চেষ্টা করেছেন। তিনি আরো বলেন, আপনিও সার্বক্ষণিক কর্মকর্তা। আমিও সার্বক্ষণিক কর্মকর্তা। আপনি কতদিন এখানে এসে উপস্থিত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন? আপনার অফিসে গিয়ে আমি কেঁদে দিয়েছি।’

পদ শূন্যের ৫৮ দিন পর, অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি পরবর্তী চার বছরের জন্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে তিনি শুরু করে দেন অপরাজনীতি। এরপর থেকে বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শুরু থেকেই শিক্ষকদের একটি পক্ষকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতে থাকেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার পদ থাকার পরও, বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবু তাহেরকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন নিয়োগে অনিয়ম করার অভিযোগ রয়েছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর কম্পিউটার অপারেটর ব্যবহারিক পরীক্ষায় ফেল করা প্রার্থীকে অফিস সহাকারী হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি। ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস উদযাপন কমিটি’ করে বিতর্ক তৈরি করেন উপাচার্য। যে কার্ড নিয়ে এত বিতর্ক সেই কার্ড প্রেসে দেওয়ার আগে ভিসি কে দেখানোর পর দেওয়া হয়েছে ছাপানোর জন্য অথচ দায়িত্ব এড়ানোর জন্য পরবর্তী তে কারা ছাপিয়েছে তাদেরকে তদন্ত কমিটি করেযা শাস্তির আওতায় আনবে বলে সারাদেশে সমালোচনা থামান ।

এছাড়াও অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকদের মোবাইল নম্বর তার ব্যক্তিগত ফোনে ব্লক করে রাখার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে তাকে ফোন করা হলে ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে গিয়ে নম্বরটি ব্লক করে দেন বলে অভিযোগ করেন সাংবাদিকরা। অভিযোগে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত একাধিক সাংবাদিক ও অন্তত দুই ডজন শিক্ষকের মোবাইল নম্বর তার মোবাইলে ব্লকের তালিকায় রয়েছে। অন্যদিকে খবরের তথ্যের প্রয়োজনে তার কার্যালয়ে সংবাদকর্মীরা গেলে সহজে সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। আগে প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে সময় নিয়েও অনেক সময় বসে থাকতে হয় সংবাদকর্মীদের।

বর্তমান সময়ের আলোচিত ঘটনা,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও ফলাফলে একজন ১২তম। পরীক্ষার দায়িত্বে যারা থাকলেন তারা কেউ বিষয়টা টেরও পেলেন না। বিবেকবান একজন শিক্ষক সেই ঘটনা প্রশাসনকে জানালেন। বিষ্ময়কর বিষয়, যাদের ব্যর্থতা বা ভুলে এই ঘটনা ঘটেছে তাদের খুঁজে বের না করে যিনি জানিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধেই এখন ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। যদিও বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তর টিভির টকশোতে সরাসরি এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন উপাচার্য।

সাংবাদিকতা বিভাগের সেই সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি গণমাধ্যমে খবরটা প্রকাশ করেছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই তিনি জানিয়েছিলেন। বিষয়টা এমন চুরি করলে দোষ নেই, চুরির তথ্য আসলেই সব সমস্যা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটকাণ্ড এখানেই শেষ নয়। সাংবাদিকতা বিভাগের আরেকজন শিক্ষক কাজী আনিসও উপাচার্য এর রষানলে পড়েছেন। তার পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়েছে। অথচ আগের সিন্ডিকেটেই তাকে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছিল।

মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগটি হল- ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের বি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও একজন শিক্ষার্থী মেধা তালিকায় ১২তম হয়। এই অসঙ্গতির বিষয়টি বি-ইউনিট কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবকে জানান প্রবেশপত্র বাছাই কমিটির সদস্য সচিব মাহবুবুল হক ভূঁইয়া। কিন্তু সে সময় কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে, পরীক্ষায় অনুপস্থিত হয়ে ১২তম হওয়া সে শিক্ষার্থীকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। পরবর্তীতে সে তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে, ওই শিক্ষার্থীর ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ হয়।

এ ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুটি তদন্ত কমিটি করে। প্রথম কমিটি ওই ঘটনায় দায়ী কারা জানায় এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে। কিন্তু এই প্রতিবেদন পছন্দ না হওয়ায় আরেকটি তদন্ত কমিটি করে কর্তৃপক্ষ। কার মাধ্যমে সাংবাদিকরা খবর পেল সেই সোর্স বের করার চেষ্টা করে কমিটি। এ যেন যিনি চুরি খুঁজে বের করলেন তাকেই ফাঁসাতে হবে। হলোও তাই। এবার তদন্ত কমিটি কল রেকর্ড বের করে জানায়, ওই খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার ২৬ সেকেন্ড আগে মাহবুব ওই সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছে। কাজেই সে-ই সাংবাদিকদের জানিয়েছে। আচ্ছা চুরি করা অপরাধ না, চুরির তথ্য প্রকাশ করা বুঝি অপরাধ?

আনিছের বিরুদ্ধে এখনকার অভিযোগ আরো হাস্যকর। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত আড়াই বছর ধরে তিনি প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি বেসরকারি আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন বছর শিক্ষকতা করেছেন। সেখান থেকে কুমিল্লায় আবেদন করার সময় বেসরকারি ওই বিশ্ববিদ্যালয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে টু রেজিস্ট্রারের বদলে টু হুম ইট মে কনসার্ন লিখেছিল। এতেই নাকি যতো বিপত্তি!

গতকাল রাতে একাত্তর টেলিভিশনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আইনুল হকের বক্তব্য শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যা থেকে শুরু করে দুনীর্তি-লুটপাটসহ নানা ঘটনা ঘটলেও সেগুলোর তদন্ত হয় না। তদন্ত রিপোর্টও প্রকাশ হয় না। আর সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে মূলত তাদের শায়েস্তা করতে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু তাহেরের বিরুদ্ধেও বরং তিনি নানা অভিযোগ করলেন।

এক সময়ের ‘রাজনীতিমুক্ত’ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত চার বছর ধরে এ বেহাল দশা। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে থমকে দেওয়া হচ্ছে। কারোর পদোন্নতি আটকে দেওয়া হচ্ছে। উপাচার্যের অপরাজনীতির শিকার হচ্ছে অনেকেই। নিজ জেলার হয়েও এহেন কর্মকান্ড ঘটাচ্ছেন তিনি।

একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি একটি আঞ্চলিক কলেজের মতো পরিচালনা করছেন বলে আমার মনে হচ্ছে। অথচ উনার সময়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও মর্যাদা যে অবস্থানে নেওয়ার কথা ছিল, তিনি তা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।

এসব দ্বন্দ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। সর্বোপরি এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। এ অবস্থায় জরুরি প্রতিকার প্রয়োজন।

আরো পড়ুনঃ